রুবা চিন্তিত। একটু একটু না, ভয়ানক চিন্তিত। খানিক পর পর পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে কিন্তু এক ঢোকের বেশি খেতে ইচ্ছে করে না। কাজের মেয়েটা কয়েকবার খেতে ডেকেছে, উত্তরে ধমক দিয়ে বলেছে, "গো টু হেল!" পরিচিত ধমক খেয়েও সে পর্দা ধরে দাড়িয়েই আছে। বেডরুমে রাখা খয়েরি টেলিফোনের কাছে রুবা হাঁটাহাঁটি করছে সমানে, কখনো বিছানে বসছে, শুয়ে পড়ছে, আবার উঠছে। অফিসের ম্যানেজার যে কোন সময় ফোন করতে পারে শুভর ব্যাপারে। আরও বেশ কয়েকজনেরও ফোন করার সম্ভবনা আছে। আপাতত এই শুভই হচ্ছে ওর ভয়ানক চিন্তার কারণ। শুভ গত দুইদিন ধরে বাসায় আসে না, অফিসেও না, মোবাইল বন্ধ, যাকে বলে পুরো লাপাত্তা। আর এরকম লাপাত্তা হওয়ার বিষয়টা শুভ ইচ্ছে করেই করে, প্রতিমাসে এক থেকে দুবার। বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে মোটমাট দশবারের অধিক শুভ এমন করেছে। তারপর হুট করে একদিন এলোমেলো চুলে ফিরে এসে রুবার সামনে দাড়িয়ে সরল হাসিটা দিয়ে বলবে, "অমুক বন্ধুর বাসায় বেড়িয়ে আসলাম। খুব ভাল বন্ধু। অনেকদিন পর দেখা, বলল বেড়িয়ে যেতে, না করতে পারলাম না। আর্থিক অবস্থা দেখলাম খারাপ, কিছু টাকাও দিয়ে এসছি। ভাল করেছি না বল?" প্রতিবারই এই ধরনের কিছু না কিছু বলে, সাথে সেই বন্ধুর একগাদা গুণকীর্তন। রুবা একটা কড়া কথাও বলতে পারে না, শুভর হাসি দেখে চোখে পানি চলে আসে। একটা মানুষ এতটা সরল কিভাবে হতে পারে? আর এই মানুষটাই কিনা ওর স্বামী। ইচ্ছে করে সারাক্ষন বুকে মাথা জড়িয়ে রাখতে।
দোতলার লম্বা বারান্দায় মাঝখানে রাখা চেয়ারে রুবা হেলান দিয়ে বসে আছে। আরেকটা চেয়ার খালি, ওখানে শুভ বসে। চাঁদের আবছা আলোয় চারপাশ কেমন অতিপ্রাকৃত লাগে। ঝিমঝিম করছে মাথা। রাত অনেক হয়ে গেল, ম্যানেজার ফোন করেনি অর্থাৎ কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। রুবার কান্না আসে, খুব ভালমতই জানে শুভ হঠাৎ চলে আসবে একসময়, তাও চিন্তা থামাতে পারে না। অফিস বাদে বাকি সময় ওকে চোখের সামনে না দেখলে কি ভয়ানক অস্থির লাগে, তা বহুবার বলেছে। তবুও কেন যে এমন করে ছেলেটা, ভেবে পায় না। ছোট থেকেই শুভ যেমন সরল তেমন বোকা। কেউ একটু নরম স্বরে কিছু বললেই বিশ্বাস করে ফেলে, উপকার করতে লেগে যায়, আরো কতকি। বড় অদ্ভুত মানুষ! কিন্তু এ শহর যে বড় ধুরন্ধর, সুযোগবাদী। বোকা পেয়ে কে কখন ওকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে কি করে বসে তার ঠিকআছে? বিয়ের দিন শুভর মা রুবার একহাত খুব শক্ত করে ধরে বলেছিলেন, "মা'রে, আমার ছেলেটা বিরক্তিকর ভাল। ওর ভালমানুষি দেখে তুমি বিরক্ত হবে, রাগ উঠবে কিন্তু মায়া ছাড়তে পারবে না। ওকে একটু মন থেকে ভালবেসো, আজ থেকে তুমি ওর সব হয়ে গেলে।" রুবার স্পষ্ট খেয়াল আছে, বলার সময় তার চোখ ছলছল করছিল। ছেলের জন্য কি গভীর মমতা। আজ বোঝে, কেন তিনি সেদিন ঐ কথাগুলো বলেছিলেন। একটা শব্দও ভুল বলেনি।
"আপা, ও আপা..." হঠাৎ কাজের মেয়েটার ডাকে হালকা কেপে উঠল রুবা। ধমক দিতে গিয়েও কেনজানি পারলো না।
- কি হয়েছে?
- ভাইয়া আইছে! ওর কন্ঠে চাপা উত্তেজনা।
- কোন ভাইয়া?
- ভাইয়া ভাইয়া... কথা শেষ করা লাগল না পুরোটা, চেয়ার উল্টিয়েই ঝট করে ছুটল রুবা, পিছে মেয়েটাও।
শুভ জামা কাপড় না পাল্টে অমনই শুয়ে পড়েছে সোফার উপর, পায়ের মোজাও খোলেনি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, চুল ওলটপালট। খুব ক্ষুধা লেগেছে। রুবাকে দেখতে পেয়েই উঠে বসল, হাসল একটু। বলল, "রুবা, খুব খিদে পেয়েছে। হাঁটাহাঁটি বেশি হইছে তো। তুমি কেমন আছো?" কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ রুবা ওর পাশে বসে ওকে দেখতে লাগল। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে মন চাচ্ছে কিন্তু দেবে না। চেহারায় রাগ আনার চেষ্টা করছে। খানিকবাদে শুভ হঠাৎ বলে বসল, "আচ্ছা তোমার কি চোখ উঠছে নাকি? চোখ এমন লাল, ভেজা ভেজা কেন?"
- হ্যা উঠছে! হার্ড ভাইরাস অ্যাটাক করছে, আস্তে আস্তে রক্ত জমবে!
- হায় আল্লাহ, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে তো আমার চোখেও ছড়াবে। এখন?
- তাকিয়ো না, কে বলছে তাকাতে? আমি মরে গেলেও বা তোমার কি? আমি তো তোমার কেউ না, নাথিং নোবডি। রুবা কেঁদে ফেলেছে। ওর নিচু করা মাথায় হাত রাখতেই শুভকে জড়িয়ে আরও জোরে কাঁদতে লাগল। এই কদিনের ভয়ানক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। শুভ বেচারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে, অবশ্য খারাপও লাগছে। খারাপ লাগছে এইজন্যে যে রুবা কষ্ট পেয়েছে, কষ্ট না পেলে কেউ এভাবে কাঁদে না। মেয়েটা বড় ভাল, অনেক ভাল।
দোতলার বারান্দায় থাকা চেয়ার দুটো এখন আর খালি নেই। শুভ রুবা পাশাপাশি বসে আছে। শুভর একহাত রুবার কোলে। কাজের মেয়েটা খাওয়া, ধোয়াপাল্লা শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে। দুজনই চুপচাপ। শুভর ঘুম পাচ্ছে কিন্তু রুবার মন খারাপ হবে দেখে উঠতে পারছে না। থাকুক, একরাত না ঘুমালে কি হয়? খাবার সময় রুবা বলেছে, "আজ সারারাত আমার সাথে বারান্দায় বসে থাকবা। আমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি।" শাস্তি পর্বই চলছে এখন। হাস্যকর শাস্তি। একটা হাই তুলে শুভ বলল, "চোখ উঠা নিয়ে জেগে থাকা ঠিক না রুবা। ঘরে ড্রপ আছে? ড্রপ দিয়ে দিই, ঘুমিয়ে পড়। কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।" রুবার ইচ্ছা হল বলে, "চোখ কেন লাল, ভেজা ছিল বোঝ না? বললাম আর চোখ উঠে গেল? দেখে বোঝ না? বোকার হাড্ডি!" কিন্তু আস্তে করে ও বলল, "লাগবে না, তোমাকে দেখে চোখ ভাল হয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে টর্চ এনে মেরে দেখ।" - ধুর, কিযে বল না তুমি। - হ্যা সত্যি। আমি যদি ধুপ করে মরেও যাই তুমি কষে আমার দুগালে দুটো চড় দেবে, দেখবে আমি উঠে গেছি।
কথা শুনে শুভ হাসছে তো হাসছেই। খিলখিল হাসি। ভারি মজা পেয়েছে, হাসির চোটে কিছু বলতেও পারছে না। রুবা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। চাঁদের আলো শুভর মুখে পড়ায় ওর মনে হচ্ছে যেন এই হাসির সাথেই আলোরা সব ঠিকরে বেরুচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই লক্ষ্মি ছেলেটা কোন মানুষ নয়, অতিপ্রাকৃত কোন এক রাজ্যের বোকা রাজপুত্র। রুবা দেখতেই থাকে। এই রাতদুপুরের নিবিড়তা ওর মুগ্ধ চোখের পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

Comments

Popular posts from this blog